Skip to main content

আজাদ : এক স্বাধীনতার নাম

শহীদ আজাদ (মাঝে)

আজাদ। বাংলায় অর্থ করলে দাঁড়ায় "মুক্ত" "স্বাধীন" মাগফার উদ্দিন চৌধুরী আজাদের গল্পটা ও মুক্তির। একজন স্বাধীনতাকামী বীর বাঙালির। যার জীবনের গল্প পড়লে আপনার চোখে পানি আসবে, যার জীবনের গল্পটা আপনার নিউরোন জাগিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু আজাদের জীবনের প্রথম দিকের গল্পটা রূপকথার রাজকুমারের মত। ১৯৪৬ সালে ঢাকার অত্যন্ত ধনী পরিবারে আজাদের জন্ম। সেসময় ঢাকার সবচেয়ে ধনীদের একজন ছিলেন আজাদের ব্যাবসায়িক বাবা। আলালের ঘরের দুলাল আজাদের বাড়িতে হরিণ থাকতো,ধবল রাজহাঁসের কলরবে বাড়ি মুখরিত থাকতো,মসলার বাগান থেকে ভেসে আসত দারুচিনির মিষ্টি গন্ধ। "দ্যা কিং" খ্যাত এলভিস প্রেসলি ছিল আজাদের সবচেয়ে পছন্দের গায়ক। প্রিয় গায়কের গান শোনার জন্য তখনকার সময়ে এক ধাক্কায় ১০০০ টাকার রেকর্ড কিনে নিয়ে বাসায় আসত আজাদ। 

১৯৬০ এর দিকে আজাদ যখন ক্লাস সিক্সে,আজাদের বাবা আরেকটা বিয়ে করতে চাইলেন। আজাদের মায়ের এই ব্যাপারে মত ছিল না। তিনি রাজপ্রাসাদ ছেড়ে আজাদকে নিয়ে আশ্রয় নেন পর্ণকুঠিরে। এরপর ছেলেকে পড়ালেখা শেখান। এইচ এস সি-র পর আজাদ করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের উপর মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন।    

সাল ১৯৭১।  যুদ্ধের দামামা বেজে গেছে। নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নে বাংলার মানুষ তখন বুঁদ। আজাদের বন্ধুরাও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে ফিরে এসেছে আগরতলা থেকে। ঢাকায় তখন তারা গেরিলা অপারেশন চালায়। আজাদ মুগ্ধ হয়ে বন্ধুদের কাছে অপারেশনের গল্প শোনে। আজাদেরও ইচ্ছে করে বন্ধুদের সাথে যুদ্ধ করার। নিজ দেশের মানুষের উপর পাকিস্তানি হানাদারদের অত্যাচার দেখে তারও কষ্ট হয়, রক্ত গরম হয়ে উঠে। কিন্তু মায়ের একমাত্র সন্তান বলে সাহস পায় না। বন্ধুরা বলে "তুই তো রাইফেল চালাতে জানিস,তোর বাবার বন্দুক নিয়ে কত শিকার করেছিস,তুই ও যুদ্ধে চল।" প্রথমে আজাদ মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সাহস পায় না কিন্তু পরে মায়ের কাছে মনের কথা খুলে বলে। বীরপ্রসবা মা সাফিয়া তার ছেলেকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য অনুমতি দিলেন। বললেন "নিশ্চয়।তোমাকে আমার প্রয়োজনের জন্য মানুষ করি নি, দেশ ও দশের জন্যই তোমাকে মানুষ করা হয়েছে।" আজাদ যুদ্ধে গেলো। দু-দুটো সফল অপারেশনে অংশ নিলো। আজাদদের বাড়িতে তার মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু কাজী,জুয়েল,আশরাফুল,বদি থাকতে শুরু করলো। অস্ত্র লুকিয়ে রাখা হলো তাদের বাড়িতে। এমন হলো যেন আজাদদের বাড়ি একটা ছোটোখাটো ক্যান্টনমেন্ট। 

২৯শে আগস্ট পাকিস্তানি হানাদাররা ঢাকায় গ্রেফতার অভিযান চালায়। বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধার সাথে মগবাজারের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয় আজাদ ও জুয়েলকে। সব মুক্তিযোদ্ধার ঠাঁই হলো নাখালপাড়ার পাকিস্তানি আর্মির টর্চার সেলে। আজাদের উপর দিন রাত অমানুষিক নির্যাতন চলে। আজাদের মা তার ছেলেকে দেখতে যায়। প্রচন্ড মারের চোটে আজাদের চোখমুখ ফুলে গেছে, ঠোঁট কেটে ঝুলছে যেন আজাদকে চেনায় যায় না। আজাদ তার মাকে বলে "মা, এরা খুব মারে। সব স্বীকার করতে বলে। বলে,সবার নাম বলে দিতে। খুব ভয় হয় মা,সহ্য করতে না পেরে যদি সব বলে দেই।" মা বলে "শক্ত হয়ে থাকো বাবা। কারো নাম বোলো না খবরদার।" আজাদ বলে "মা,দুইদিন হলো ভাত খায় না। কাল ভাত দিয়েছিলো। ভাগে পায় নি। খুব ভাত খেতে ইচ্ছে করে মা,এরপর আসার সময় আমার জন্য ভাত নিয়ে এসো।" মায়ের বুকের ভিতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যায়। পরদিন  মা তার ছেলের জন্য রমনা থানায় ভাত নিয়ে যান কিন্তু আজাদকে আর পান না। ধারণা করা হয় ঘাতকরা সেদিনই ছেলে আজাদকে মেরে ফেলে। 

আজাদের মা তার ছেলের অপেক্ষায় থাকে এই বুঝি তার ছেলে ফিরে এসে ভাত খেতে চাইবে। কিন্তু আজাদ আর ফেরে নি। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন আজাদের মা। জীবনের শেষ ১৪ বছরে তিনি এক দানা ভাত ও মুখে দেন নি। শুয়েছেন মেঝেতে। কারণ তার ছেলে মৃত্যুর আগে ভাত চেয়ে খেতে পায় নি। শুয়ে থেকেছে মেঝেতে। ১৯৮৫ সালের ৩০ আগস্ট মারা যান শহীদ আজাদের মা। তাঁর কবরের নাম ফলকের জায়গায় লিখা হয় "মোসাম্মৎ সাফিয়া বেগম: শহীদ আজাদের মা"

দেশের প্রতি মা-ছেলের এই ত্যাগের গল্পটা জন্ম দিক হাজার আজাদের। 

Comments